বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:প্রার্থী তালিকা নিয়ে তৃণমূলের পর অসন্তোষ গেরুয়া শিবিরেও। রবিবার বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর দলই ছেড়ে দিলেন শোভন–বৈশাখী। বেহালা পূর্বে শোভন প্রার্থী না হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সরকারি ভাবে এখনও মুখ খোলেনি বিজেপি। রবিবার এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই তৃতীয় ও চতুর্থ দফার ৬৩টি কেন্দ্রে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বিজেপি। এর পরই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিজেপির কর্মী অসন্তোষের খবর আসতে শুরু করেছে। খবর পৌঁছেছে দিল্লিতেও। স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মুখ খুলেছেন। বলেছেন, ‘দলে অনেকেই থাকে। সবাই প্রার্থী হন না। কেউ কেউ হন। বাকিরা দলের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার জন্য কাজ করেন।’ তাঁর ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট বলেই মনে করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।
একদিন নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে তৃণমূল ছেড়ে ছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। তার পর শোভন–বৈশাখী সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট আলোড় তৈরি হয় রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে। পরে ওই দু’জনই বিজেপিতে যোগ দেন। তার পরও নানা সময়ে বিজেপিতেই দলের সঙ্গে তাঁদের মতবিরোধ এবং মান–অভিমান শুরু হয়। আলাপ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সেই বিতর্ক থামানো হয়। কিন্তু রবিবার আর তাঁদের অভিমানের মীমাংসা করা গেল না। বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কই ছিন্ন করে দিলেন শোভন–বৈশাখী। দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে তাঁরা দল ছাড়ার কথা জানিয়েও দিয়েছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কাছে সেই চিঠি পৌঁছে গিয়েছে বলে খবর। রবিবার বিজেপি তৃতীয় ও চতুর্থ দফার যে প্রার্থী–তালিকা ঘোষণা করে, তা নাকি এই জুটির পছন্দ হয়নি। সেইজন্যই তাঁরা দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শোভন–বৈশাখী জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা বিজেপির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবেন না।
এদিন ফেসবুকে বৈশাখী লেখেন, ‘তুমি সবসময় আমার বিগ্রহ। আজ যে ভাবে অসম্মান করা হল, সেটা আমাদের ‘স্পিরিট’ নষ্ট করে দিতে পারবে না। আমরা আবার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ফিরে আসব। চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। বেহালা পূর্বের মানুষ তোমায় ভালবাসে, আর সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি।’ পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ফেসবুকে ওই পোস্টই তাঁর প্রতিক্রিয়া। সূত্রের খবর, বেহালা পূর্বে বিজেপির প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে ছিল শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু বিজেপি সেখানে প্রার্থী করেছে অভিনেত্রী পায়েল সরকারকে। পাশাপাশি কলকাতা বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোনও কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হওয়ার আশা করেছিলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বৈশাখীকে এখনও কোনও আসনে প্রার্থী করেনি বিজেপি। সেই কারণেই শোভন–বৈশাখী দল ছাড়লেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, প্রকাশ্যে এ নিয়ে এখনও কোনও মতামত দেয়নি বিজেপি। তবে দলের এক নেতা ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, শোভন চট্টোপাধ্যায়কে বেহালা পূর্বে প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত দল অনেক ভাবনাচিন্তা করেই নিয়েছে। কারণ, ওই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে শোভনের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়কে। এখন বিজেপি যদি ওই কেন্দ্রে শোভনকে প্রার্থী করত, তা হলে সেখানে তিনি প্রচারে যেতেন বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে। এই ঘটনা বিজেপি কর্মী তো বটেই, সাধারণ মানুষের কাছেও ভুল বার্তা দিত। তা বিজেপির মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের ক্ষেত্রে মানানসই হত না। তাই শোভনকে তারা ওই কেন্দ্রে প্রার্থী করেনি। বিজেপির একটি সূত্রের খবর, শোভন–বৈশাখীকে নিয়ে প্রথম দিকে গেরুয়া শিবিরের আগ্রহ থাকলে, তাঁদের নিত্যনৈমিত্তিক বায়নাক্কায় দলে তাঁদের গুরুত্ব কমছিল। শুধু তাই নয়, শেষ দিকে রীতিমতো বোঝা হয়ে উঠছিলেন তাঁরা। এই বোঝাকে ঘাড় থেকে নামাতে চাইছিলেন দলের অনেক নেতাই। শোভন–বৈশাখী নিজেরাই সরে যাওয়ায় বিজেপির সুবিধেই হল বলে সেই নেতাদের ধারণা।
অনেকে মনে করছেন, এবার শোভন–বৈশাখী তৃণমূলের দ্বারস্থ হতে পারে। কিন্তু রত্না চট্টোপাধ্যায়কে সরিয়ে শোভনকে বেহালা পূর্বে তৃণমূল প্রার্থী করবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। যদি তা করা হয়, দলের কর্মীদের কাছে কী বার্তা যাবে, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতে হবে দলনেত্রীকে। কারণ, কয়েকদিন আগেই বেহালায় বিজেপির হয়ে শোভাযাত্রা করার সময় তৃণমূল কর্মীরা শোভন–বৈশাখীকে কালো পতাকা, জুতো, ঝাঁড়ু দেখিয়েছিলেন। এখন শোভন চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করলে রাতারাতি ভোল বদলে তাঁরা তাঁকে সাদরে কী ভাবে বরণ করে নেবেন, তা নিয়ে সংশয়ে থাকতে হবে তৃণমূল নেতৃত্বকে। শুধু শোভন–বৈশাখীই নন, দলের অনেক নেতাই প্রার্থী হতে না পেরে ক্ষোভ গোপন রাখেননি। চুঁচুড়ায় লকেট চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন সেখানকার বিজেপি নেতা সুবীর নাগ। তবে তিনি অন্য কোনও দলে যোগ দিচ্ছেন না। রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি।
প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের পর শোভন–বৈশাখী ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় বিজেপি নেতা ও কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষের খবর আসতে শুরু করেছে। সিঙ্গুরে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করা রীতিমতো বিক্ষোভ দেখান বিজেপি কর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, এতদিন তৃণমূল নেতা হয়ে তিনি বিজেপির ক্ষতিই করে গিয়েছেন। এবার তৃণমূলে প্রার্থী হতে না পেরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁকে প্রার্থী করায় এতদিন সমস্ত বিপদ অগ্রাহ্য করে যে বিজেপি নেতা ও কর্মীরা লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে দল ঠিক ব্যবহার করেনি। এমনকী, রাজ্যে প্রচারে আসা মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের মন্ত্রীকেও ঘেরাও করে রাখেন তাঁরা। এদিন প্রার্থী হওয়ার কথা শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন রন্তিদেব সেনগুপ্তও। তাঁকে হাওড়া দক্ষিণে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। সেই খবর পেয়েই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি প্রার্থী হতে চাইনি। আমি দলের হয়ে প্রচার করব। কিন্তু দল আমাকে না জানিয়েই প্রার্থী করে দিয়েছে। হাওড়া দক্ষিণে দল উপযুক্ত প্রার্থী বেছে নিক।’
পরে অবশ্য দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতাদের অনুরোধে তাঁর মন গলে। তিনি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হন। বলেন, ‘দলের অনুরোধে আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি। আমি হাওড়া দক্ষিণ কেন্দ্র থেকেই ভোটে লড়াই করব। দলের নেতাদের অনুরোধ আমার কাছে নির্দেশের মতো। একটি শৃঙ্খলাপরায়ন দলের সদস্য হিসেবে আমি নির্দেশ মেনে চলব।’ অসন্তোষ ডায়মন্ড হারবারেও। সেখানে দীপক হালদারকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। কয়েকদিন আগেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। এদিন দলের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিজেপি কর্মীরা বিক্ষোভ দেখান। বিজেপির জেলা সভাপতি দেবাংশু পণ্ডার অভিযোগ, ‘তৃণমূলে থাকার সময় বিজেপি কর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি। সেই তিনি কী করে দলের প্রার্থী হয়ে যান?’